ইউরোপে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি কীভাবে ঘটেছিল
অথবা, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে লেখো
অথবা, নবজাগরণের যুগে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের অগ্রগতি আলোচনা করো

ইউরোপে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি
আধুনিক যুগে প্রযুক্তি ও কারিগরি বিদ্যার উন্নতি ঘটলে, তার প্রভাব পড়ে জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও। এর দরুন তৈরি উন্নত জলযানের সাহায্যে মানুষ দূরদূরান্তে নতুন ভূখণ্ডে পৌঁছোতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি এই শিল্পের অগ্রগতি প্রভাবিত করেছিল নানান দেশের শিল্প, বাণিজ্য, সামরিক-সহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকেও।
(1) সহায়ক উপাদানের ব্যবহার: প্রাচীন কালে জলযানগুলি অত্যন্ত ধীরগতিতে চলত। সেসময় জলযানের প্রধান সহায়ক সামগ্রী ছিল দাঁড়, বৈঠা প্রভৃতি। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে জাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কিত কম্পাস এবং চতুর্দশ শতকে যান্ত্রিক ঘড়ির আবিষ্কারের দরুন নৌযাত্রায় গতি আসে। সেইসঙ্গে দূরবীক্ষণ যন্ত্র হয়ে ওঠে নাবিকদের সমুদ্রযাত্রার অন্যতম অস্ত্র। তাছাড়া মানচিত্র অঙ্কনও ছিল অন্যতম সহায়ক উপাদান। চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতকে এক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতি ঘটে। ফলত দূরদূরান্তে মহাসাগরে জাহাজ চলাচলে সুবিধা হয়। পরবর্তীকালে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার জাহাজ নির্মাণকে আরও উন্নত করে তোলে।
(2) নৌশিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার: খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ (মতান্তরে দ্বাদশ শতক) শতক নাগাদ জাহাজে হালের ব্যবহার শুরু হয়। পাশাপাশি মাস্তুল, পাল, দাঁড় প্রভৃতির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে জলযানের উন্নতি ঘটে। এসময় বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রয়োজনে জলপথকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দূরদেশে যেতে মানুষ উদ্যোগী হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই তাগিদ থেকেই প্রযুক্তিতেও আসে উন্নতি। আবিষ্কৃত হয় জাহাজের গতি নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি, নদীপথে লকগেট তৈরির প্রযুক্তি (চতুর্দশ শতক) প্রভৃতি। নৌশিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহারের এই ধারাই পরবর্তী সময়ে আরও বিকশিত হয়ে ওঠে।
(3) নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন: পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে বিজ্ঞানচর্চার উন্নতি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পথ খুলে দেয়। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন সম্ভব হয়। ইতিপূর্বে ভূমধ্যসাগরীয় জলযানগুলি ছিল নৌকাকৃতির ক্ষুদ্র পোত বিশেষ। এই ছোটো আকারের গ্যালি (Galley) নৌকা ইতালীয় বণিকদের উপসাগরীয় বাণিজ্যে ব্যবহৃত হত। তবে সমুদ্র অভিযানের পক্ষে এগুলি উপযুক্ত ছিল না। উত্তর ইউরোপ তথা আটল্যান্টিক ও উত্তর সাগর সন্নিহিত দেশগুলি তুলনামূলকভাবে বৃহৎ নৌযান ব্যবহার করত।
(4) উন্নত জলযান নির্মাণ: পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আইবেরীয় উপদ্বীপের নাবিকেরা এক নতুন ধরনের জলযান প্রস্তুত করেন। এটি সম্ভবত আরবীয় ধৌ (Dhow) এবং চিনা জাঙ্ক (Junk) জলযানের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। মীনাক্ষী ফুকনের মতে, বর্গাকার এবং কোণবিশিষ্ট লম্বাটে জলযানের এই সমন্বয় নিঃসন্দেহে ইউরোপীয় জাহাজ নির্মাণের কাজে অগ্রগতির অন্যতম দৃষ্টান্ত। এটি ছিল আশি টনের ত্রিকোণবিশিষ্ট লঘুগামী পোত, যা ক্যারাভেল (Caravel) নামে পরিচিত। সমুদ্র অভিযানের উপযোগী এমনই তিনটি জাহাজ নিয়ে কলম্বাস আটল্যান্টিক পাড়ি দিয়েছিলেন। এদেরই একটি পোত সান্তামারিয়া উপকূল সন্নিহিত শৈলশিলায় আঘাত খেয়ে ভেঙে পড়ে।
(5) বৃহদাকার জাহাজ নির্মাণ: দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা এবং বৃহৎ বাণিজ্যের জন্য বৃহদাকার জাহাজ নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়। ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় প্রযুক্তিবিদরা বাণিজ্য জাহাজ (কার্গো) নির্মাণ করতে সক্ষম হন। একে বলা হত ক্যারাক (Carrack) জাহাজ। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময় এক হাজার টনের ক্যারাক জাহাজ আটল্যান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে নিয়মিত চলাচল করতে সক্ষম হয়। কামান ও আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত এই মধ্যাকৃতির দ্রুতগামী জাহাজগুলি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। দিকনির্ণয় যন্ত্র, একাধিক পাল ও দাঁড় সমন্বিত এই জাহাজগুলি সমুদ্রযাত্রাকে অনেকটাই নিরাপদ ও আকর্ষণীয় করে তোলে।
(6) ইংল্যান্ডের ভূমিকা: পঞ্চদশ শতক ও তার পরবর্তী সময়ে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ইংল্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টিউডর রাজা অষ্টম হেনরির আমলে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করা, জাহাজে ভারী কামান বসানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলি সাধিত হয়। পরবর্তীতে রানি প্রথম এলিজাবেথের নৌ-সেনাপতি জন হকিন্স নৌশিল্পে নানা সংস্কারসাধন করেন। তিনি একদিকে যেমন ছোটো, দ্রুতগামী এবং আক্রমণাত্মক জাহাজ তৈরি করেন, অন্যদিকে গভীর সমুদ্রে পাড়ি জমানোর জন্য বড়ো জাহাজও নির্মাণ করেন। এগুলি ছাড়া ইংল্যান্ডে গঠিত হয় বেশকিছু জাহাজ নির্মাণ কারখানা, যা নৌশিল্পে বিশেষ অগ্রগতি ঘটায়।
(7) অন্যান্য দেশের ভূমিকা: নৌ-প্রযুক্তির অগ্রগতিতে ইউরোপের অন্যান্য দেশও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এসময় ক্লিংকার বিল্ট (Clinker- built) পদ্ধতিতেও জাহাজ নির্মাণ করা হত। সুইডেন, ডেনমার্ক, স্পেন, পোর্তুগালের মতো দেশগুলিতেও নৌ-প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে।
মূল্যায়ন
ইউরোপে মাত্র দুইশতক কালে জাহাজ নির্মাণ প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি প্রসঙ্গে মীনাক্ষী ফুকন লিখেছেন যে, ‘পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় সমুদ্রগামী ইউরোপীয় জলযানগুলি প্রাচ্যের তুলনায় গঠনশৈলী ও কার্যকারিতার বিচারে খুবই নিম্নমানের ছিল, কিন্তু ষোড়শ শতকের শেষপর্বে ইউরোপের জাহাজগুলি তাদের সমুদ্র উপযোগিতা, বহনক্ষমতা, যুদ্ধক্ষমতা ইত্যাদির বিচারে প্রাচ্যদেশীয় জলযানের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত রূপ পেয়েছিল।’ বলাবাহুল্য, জাহাজ নির্মাণ শিল্পের এই উন্নতি ইউরোপকে বিশ্ববিজয়ের উপযোগী করে তুলেছিল।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর